বাণী ইয়াসমিন হাসি :১৯৭৫ সালে সংসদে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি মাল্টি-ক্লাস পার্টি। আমি তার নামের আগে কৃষক শ্রমিক লাগিয়েছি বৈকি, কিন্তু দলটির চরিত্র এখনও বদলাতে পারিনি, রাতারাতি সব সম্ভবও নয়। আমার দলে নব্য-ধনীরাও আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তাদের লুটপাটের সুযোগ বহুগুণ বেড়ে গেছে। আমি তাদের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই বাকশাল করেছি। যদি এই ব্যবস্থা সফল করতে ব্যর্থ হই এবং আমার মৃত্যু ঘটে, তাহলে দলকে কবজা করে ওরা আরও লুটপাটে উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে। এমনকি শত্রুপক্ষের নীতি ও চরিত্র অনুসরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের মূলমন্ত্র, এমনকি আওয়ামী লীগের চরিত্র ও নীতি পাল্টে ফেলতে পারে। যদি তা হয়, সেটাই হবে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু। সেজন্য আগেই বলেছি, আমার দল, আমার অনুসারীদের হাতেই যদি আমার এই দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে, তাহলে দীর্ঘকালের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে যেতে হবে। কবে ফিরব তা জানি না।
না, ‘বিস্মৃতির অন্ধকারে’ বঙ্গবন্ধুকে যেতে হয়নি; হবেও না। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত সময়ে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সংবেদনশীল ইস্যুগুলোতে হাত দিয়ে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর সেসব বক্তৃতায় তিনি প্রশাসনিক কাঠামো থেকে শুরু করে ভূমিস্বত্ব পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রের কতগুলো অচল ব্যবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তফসিল ঘোষণা করা হবে ২০২৩ সালের নভেম্বরে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সমীকরণে এবারের নির্বাচনের হিসাবটা বেশ জটিল। প্রস্তুতি হিসেবে ঘর গোছানোর কাজে হাত দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ বছরের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। তার আগেই সব জেলা-উপজেলার সম্মেলন শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে প্রাচীণ ও ঐতিহ্যবাহী দলটি।
আমরা গণমাধ্যমে প্রায়ই কমিটি গঠন নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ, বাণিজ্য, হট্টগোল, মারামারি, গোলাগুলির খবর পড়ি। যদিও ফিল্টারিংয়ের কারণে সব খবর গণমাধ্যমে আসে না।
এমপির সঙ্গে দ্বন্দ্ব : স্বাস্থ্যসচিব অবরুদ্ধ, এসি ল্যান্ড পুকুরে। ২০২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির একটি খবরের শিরোনাম। এবার ঘটনার গভীরে যাওয়া যাক। তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব আবদুল মান্নান ও কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদের বাড়ি একই গ্রামে। গ্রামের নাম চানপুর। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার এই জনপদে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ নিয়ে তাদের মধ্যে চলছিলো দ্বন্দ্ব। এরই জেরে ঘটে তুলকালাম ঘটনা। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থলে যায় র্যাব। অভিযোগের বিষয়ে সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ সেই সময়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ক্লিনিকের রাস্তা করা নিয়ে স্থানীয়রা ভোগান্তির শিকার হওয়ায় তাকে (স্বাস্থ্যসচিব) জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিল। তখন স্বাস্থ্যসচিব তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। এতে তারা ক্ষুব্ধ হন। যাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যসচিবের গণ্ডগোল হয়েছে তারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করলেই এই ঘটনা এড়ানো যেতো।
মূলত আমলা তার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়েই সেদিনের প্রতিটি গণমাধ্যমে জায়গা করে নেন। আমি এখনকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বলি কর্পোরেট লীগ। একদল আমলা এবং ব্যবসায়ী পুরো সংগঠনকে কবজা করছে। প্রকৃত রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা।
সুদিনের পাখিরা উড়াল দেবেই। একটা সংকট এলে সুবিধাভোগীরা কেউই থাকবে না। ঘুরেফিরে সেই পরীক্ষিতরাই মাঠে থাকবেন। ওয়ান ইলেভেন অনেক কিছুই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। চাপের কাছে বশ্যতা বা নতি স্বীকার যেমন দেখেছি, তেমনি কারো কারো ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তাও দেখেছি। বিএনপি জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের সময় অনেকেই গর্তে ঢুকে গিয়েছিল। আবার কেউ কেউ বুক চিতিয়ে প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিল।
এই ২৪ ডিসেম্বরের কাউন্সিলে মনোনীত নেতৃত্বই বলে দেবে দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কোন পথে হাঁটবে? যে রাজনৈতিক দলের হাত ধরে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের জন্ম সেই দলের ভাগ্যের সাথে দেশের ভাগ্যও জড়িয়ে থাকে বৈকি। আগামী নির্বাচন এবং সামনের দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলার জন্য সৎ, সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীই নয়, গোটা দেশ চেয়ে আছে, কে হচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনার পরবর্তী রানিংমেট?
লেখক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট ও
পরিচালক, জাগরণ টিভি। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন